Friday, August 17, 2018

আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ (পর্ব ১)

অহঙ্কার বা তাকাব্বুর

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
আল্লাহর পথে চলতে সচেষ্ট ও ধর্ম-সচেতন অনেক মানুষ অনেক সময় এসব ইবাদত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যান। অনেক সচেতন মুসলিম ব্যভিচার, মিথ্যা, মদপান, সালাত বা সিয়াম পরিত্যাগ ইত্যাদি পাপে কখনোই লিপ্ত হন না। কখনো এরূপ কিছু করলে সকাতরে তাওবা-ইসতিগফার করতে থাকেন। কিন্তু জেনে অথবা না জেনে তাঁরা র্শিক, কুফ্র, বিদ‘আত, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, আত্মতুষ্টি, গীবত ইত্যাদি পাপের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছেন।
এর কারণ, কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই শয়তান কখনো নিরাশ হয় না। প্রত্যেক মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত করতে সে সদা সচেষ্ট। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তার নিজস্ব পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী রয়েছে। সবাইকেই সে পরিপূর্ণ ধর্মহীন অবিশ্বাসী করতে চায়। যাদের ক্ষেত্রে সে তা করতে সক্ষম না হয় তাদেরকে সে ‘ধর্মের আবরণে’ পাপের মধ্যে লিপ্ত করে। অথবা বিভিন্ন প্রকার ‘অন্তরের পাপে’ লিপ্ত করে, যেগুলো নেককার মানুষের নেক-আমল নষ্ট করে দেয়, অথচ সেগুলোকে অনুধাবন করা অনেক সময় ধার্মিক মানুষের জন্যও কষ্টকর হয়ে যায়। এ জাতীয় কিছু পাপের কথা ইতিপূর্বে “শিরক, কুফর ও নিফাক” ও সকল বিদআত কর্মই মূলত জায়েজ” প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আরো কিছু আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
অহঙ্কার বা তাকাব্বুর
নিজেকে অন্য কোনো মানুষ থেকে কোনো দিক থেকে উন্নত, উত্তম বা বড় মনে করা, অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের চেয়ে হেয় মনে করাই অহঙ্কার। এটি মূলত একটি মানসিক অনুভূতি, তবে কর্মের মধ্যে কিছু প্রকাশ থাকে। অহঙ্কার একমাত্র আল্লাহর অধিকার। কোনো মানুষের অহঙ্কার করা মূলত আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ। কারণ, আল্লাহর নিয়ামত নিয়েই মানুষ অহঙ্কারে লিপ্ত হয়।
পৃথিবীর সকল নিয়ামত আল্লাহ সবাইকে সমানভাবে প্রদান করেন না। কাউকে দেন, কাউকে দেন না অথবা কমবেশি প্রদান করেন। যিনি নিয়ামত পেয়েছেন তার দায়িত্ব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু যদি তিনি এ নিয়ামতকে আল্লাহর দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসেবে গ্রহণ না করে নিজের উপার্জন ও সম্পদ মনে করেন তখনই অহঙ্কারের শুরু হয়। এতে প্রথমেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
পাঠক হয়ত প্রশ্ন করবেনÑবাস্তবে আমরা দুনিয়াতে বড় ছোট রয়েছি। কাজেই তা অস্বীকার করব কিভাবে ? কেউ বেশি জ্ঞানী , ডিগ্রিধারী, সম্পদশালী, শক্তিশালী, … কেউ কম। কাজেই যার বেশি আছে তিনি কিভাবে যার কম আছে তাকে সমান ভাববেন ?
বিষয়টি এখানে নয়। আপনার জ্ঞান, সম্পদ, সৌন্দর্য, প্রভাব, শক্তি, বাকপটুতা, ডিগ্রি, পদমর্যাদা, ইত্যাদি হয়ত আপনার আরেক ভাই থেকে বেশি। এখন প্রশ্ন , আপনার নিকট যে সম্পদটি বেশি আছে তা আপনার নিজস্ব উপার্জন না আল্লাহর দয়ার দান? যদি আল্লাহর দয়ার দান বলে আপনি বিশ্বাস করেন তাহলে আপনি কখনই নিজেকে তার চেয়ে বড় বলে বা তাকে আপনার চেয়ে হেয় বলে ভাবতে পারবেন না। আপনি ভাববেন Ñ আল্লাহর কত দয়া! আমাকে দয়া করে এ নিয়ামতটি দিয়েছেন অথচ তাকে দেননি। ইচ্ছা করলে তিনি এর বিপরীত করতে পারতেন। একান্ত দয়া করেই তিনি আমাকে নিয়ামত দিয়েছেন। আমার কাজ , বেশি বেশি শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে নিয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো। এ অনুভূতি মুমিনের। এ অনুভূতি থাকলে কোনো মানুষ নিজেকে কারো চেয়ে বড় ভাবতে পারে না। বড়জোর নিজেকে ‘বেশি দয়াপ্রাপ্ত’ বলে মনে করতে পারে। এই মানুষটি কখনোই অন্য কাউকে তার চেয়ে হেয় বলে অবজ্ঞা করার কথা চিন্তা করে না। সে কখনো আল্লাহর দয়ার দানকে নিয়ে মনের মধ্যে গোপনে বা মুখে প্রকাশ্যে বড়াই করতে পারে না।
অহঙ্কার ও মুমিনের কৃতজ্ঞতার অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য দেখুন। আপনি একজন মানুষকে দেখলেন সে কথাবার্তায়, ভদ্রতায়, ডিগ্রিতে, অর্থে, শিক্ষায়, সৌন্দর্যে বা অন্য কোনো দিক থেকে আপনার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থানে রয়েছেন। তাকে দেখে আপনার মনে বা অনেকের মনে হাসি, অবজ্ঞা বা উপহাস উৎপন্ন হচ্ছে। অথচ আপনাকে দেখে আপনার মনে বা অন্যদের মনে ভক্তি ও শ্রদ্ধা বোধ জাগছে। আপনি কি করবেন ? অবজ্ঞা ও অবহেলা ভরে তার দিকে তাকাবেন? Ñ এটিই তো অহঙ্কার। আপনি আল্লাহর দেওয়া সকল নিয়ামতকে অস্বীকার করে আল্লাহর সাথে অবিশ্বাসীর মতো ব্যবহার করলেন।
মুমিনের মনে এ পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যাবে। অপরদিকে সে ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ একটুও কমবে না। তিনিও আমার মতোই আল্লাহর বান্দা। তাকে আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন তা নিয়েই তিনি রয়েছেন। তাকে সম্মান করতে হবে। তার জন্য দু‘আ করতে হবে। কোনো অবস্থায় তার প্রতি অবজ্ঞার প্রশ্নই আসে না।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো জানি না, এ কমজ্ঞানী, অভদ্র, দুর্বল বা অবজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষটি আল্লাহর কাছে কতটুকু প্রিয়। আমি জানি না, কিয়ামতের দিন আমার অবস্থা কী হবে আর তার অবস্থা কী হবে। হয়ত এ অবহেলিত দুর্বল মানুষটি কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত বেশি লাভ করবে। হয়ত আমার চেয়ে অনেক সম্মানপ্রাপ্ত হবে। হয়ত আমাকে আল্লাহর নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতার অপরাধে ধরা পড়তে হবে। তাহলে আমার জন্য অহঙ্কারের সুযোগটা কোথায় ?
অহঙ্কার সকল ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক অনুভূতি। তবে তা যদি আল্লাহর ইবাদত কেন্দ্রিক হয় তাহলে তা আরো বেশি ক্ষতিকারক। নিজেকে ভাল দ্বীনদার মনে করা শয়তানের অন্যতম চক্রান্ত। সাথে সাথে যদি নিজেকে অন্য কোনো মুসলমানের চেয়ে বেশি দ্বীনদার মনে করা হয় তাহলে ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ হয়।
পাঠক হয়ত আবারো প্রশ্ন করবেন, ধর্ম পালনে তো কম-বেশি আছেই। আমি দাড়ি রেখেছি, আরেকজন রাখেনি। আমি যিক্র করি অথচ সে করে না। আমি বিদ‘আতমুক্ত, অথচ অমুক বিদ‘আতে জড়িত। আমি সুন্নাত পালন করি কিন্তু অমুক করে না। আমি ইসলামের দাওয়াত, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছি অথচ আমার আরেক ভাই শুধুমাত্র সালাত-সিয়াম পালন করেই আরামে সংসার করছেন। এখন কি আমি ভাবব যে, আমি ও সে সমান বা আমি তার চেয়ে খারাপ? তাহলে আমার এত কষ্টের প্রয়োজন কি ?
প্রিয় পাঠক, বিষয়টি আবারো ভুল খাতে চলে গেছে। প্রথমত, আমি যা কিছু করেছি সবই আল্লাহর দয়া, রহমত ও তাওফীক হিসেবে তাঁর দরবারে শুকরিয়া জানাতে হবে এবং এ নিয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য সকাতরে দু‘আ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে ভাই এ সকল নিয়ামত পাননি তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করতে হবে, যেন আল্লাহ তাকেও এ সকল নিয়ামত প্রদান করেন এবং আমরা একত্রে আল্লাহর জান্নাতে ও রহমতের মধ্যে থাকতে পারি। তৃতীয়ত, আমাকে খুব বেশি করে বুঝতে হবে যে, আমি যা কিছু করছি তা আমার প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের তুলনায় খুবই কম। আমি কখনোই আল্লহর দেওয়া দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারিনি। কাজেই, আমার তৃপ্ত হওয়ার মতো কিছুই নেই। চতুর্থত, আমাকে বারবার সজাগ হতে হবে যে, আমি জানি না আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণ হচ্ছে কি না ? হয়ত আমার এ সকল ইবাদত বিভিন্ন ভুল ও অন্যায়ের কারণে কবুল হচ্ছে না, অথচ যাকে আমি আমার চেয়ে ছোট ভাবছি তার অল্প আমলই আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন, কাজেই কিভাবে আমি নিজেকে বড় ভাবব? পঞ্চম, আমি জানি না, আমার কী পরিণতি ও তার কী পরিণতি ? হয়ত মৃত্যুর আগে সে আমার চেয়ে ভাল কাজ করে আমার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ দরবারে হাজিরা দেবে।
মুহতারাম পাঠক, কিয়ামতের হিসাব নিকাশ শেষে জান্নাতে প্রবেশের আগে কখনো কোনো মুমিন নিশ্চিত হতে পারে না, নিজেকে অন্য কারো চেয়ে উত্তম বা বেশি ধার্মিক ভাবা তো দূরের কথা! সাহাবী, তাবেয়ীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের শ্রেষ্ঠতম বুজুর্গ ও নেককার মানুষেরা নিজেদেরেকে জীবজানোয়ারের চেয়ে উত্তম ভাবতে পারতেন না। তাঁরা বলতেন, কিয়ামতের বিচার পার হওয়ার পরেই বুঝতে পারব, আমি পশুদের চেয়ে নিকৃষ্ট না তাদের চেয়ে উত্তম। অহঙ্কার আমাদের নেক কর্ম বিনষ্ট করে দেয়। যার অন্তরে অহঙ্কার থাকবে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। ইবনু মাস’ঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
“যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
মুসলিম (২-কিতাব ঈমান, ৩৯-বাব তাহারীমিল কিবর) ১/৯৩, নং ৯১ (ভারতীয় ১/৬৫)।

সুপ্রিয় পাঠক, অহঙ্কার অন্তরের কর্ম হওয়ার কারণে আমরা সহজে তা ধরতে পারি না। আমরা মনে করি যে, আমার মধ্যে অহঙ্কার নেই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার মধ্যে অহঙ্কার বিদ্যমান। বিভিন্নভাবে তা যাচাই করা যায়। অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় মানুষের মধ্যে বেরোতে কি আপনার লজ্জা বোধ হয়? এরূপ পোশাক পরিহিত অবস্থায় যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আপনাকে দেখে ফেলেন তবে কি খুব সংকোচ বোধ হয়? যদি হয় তবে বুঝতে হবে যে, মনের মধ্যে অহঙ্কার বিদ্যমান।
কোনো মাজলিসে পিছনে বা নিচে বসতে হলে কি আপনার খারাপ লাগে? মনের মধ্যে কি আশা হয় যে, কেউ আপনাকে ডেকে সম্মান করুক, আগে সালাম দিক? যদি হয় তবে বুঝবেন যে, অহঙ্কার অন্তরে লুকিয়ে রয়েছে।
অন্তরের মধ্যে অহঙ্কারের অনুপ্রবেশ রোধের জন্য মুমিনকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু হানযালা বলেন, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রা) মাথায় এক বোঝা খড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে বলা হলো, আপনি কেন এ কাজ করছেন? আল্লাহ তো আপনাকে সচ্ছলতা দিয়েছেন, যাতে এমন না করলেও আপনার চলে? তিনি বলেন, আমি অন্তরের অহঙ্কার ও অহংবোধকে আহত করতে চাচ্ছি। আমি রাসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছি, যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” হাদীসটি হাসান। হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৪৭০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯৯।

No comments:

Post a Comment